সুলতানা কামাল
জীবনে এমন কিছু দিন আসে, সেটা ব্যক্তিগত ক্ষেত্রেই হোক কি জাতীয় পর্যায়ে; মনে হয় সে দিনটি আসলে ছিল এক দুঃস্বপ্ন। ভাবতে চাই, প্রকৃতপক্ষে ঘটনাটি বাস্তবে ঘটেনি। কিন্তু বুকের গভীরে জমে থাকা বেদনা জানিয়ে দিতে থাকে- সেটা ঘটেছে, সেটাই বাস্তব। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যাসন্তান ব্যতীত সপরিবারে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের দিনটি তেমনই এক কষ্টের বোধ নিয়ে ঘুরে ঘুরে আসে আমাদের জীবনে। এখনও যেন সেদিনের সকালবেলার গোলাগুলির শব্দ কানে এসে বাজে।
ধানমন্ডির একই সড়কে আমাদের বাস। তাই আমাদের প্রতিবেশী ছিলেন বঙ্গবন্ধুর পরিবার। তখন ধানমন্ডিতে এত উঁচু উঁচু আকাশছোঁয়া ইমারত তৈরি হয়নি। বেশ দূর থেকেই একে অপরের বাড়িগুলো দেখতে পেতাম। গোলাগুলির শব্দে দৌড়ে গেটের বাইরে এসে দেখলাম, ট্যাঙ্ক দিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিককার পথটা আটক রাখা হয়েছে। সেদিকে কাউকে চলাচল করতে দেওয়া হচ্ছে না। কিছু সময়ের জন্য আমরা বিহ্বল, নিঃসাড়। কিছু বোঝার কোনো উপায় বের করতে পারছিলাম না। এক আত্মীয় খবর দিলেন- ভয়ংকর বিপর্যয় ঘটে গেছে! আমরা যেন রেডিও শুনি। তখন প্রায় সকাল ১০টা। বেতারে বেতারে সেই অবিশ্বাস্য ঘটনার বিবরণ বেজে চলেছে। তখনও মনে হচ্ছিল- এ সত্য হতে পারে না।
এক সময় সদর্পে জনসমক্ষে দেখা দিল বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের স্বঘোষিত খুনিরা। মূলত সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য এবং তাদের সঙ্গে দুই-একজন আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। বিস্ময়-বিমূঢ় সাধারণ মানুষ এ ঘটনার কোনো কার্যকারণ বুঝে ওঠার আগেই দৃশ্যপটে আগমন ঘটতে থাকল আরও কুশী-লবের। যে কোনো হত্যাকারীর মতোই তারা তাদের কৃতকর্মের সাফাই গাইতে থাকল।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে দেশের শাসনব্যবস্থা নিয়ে যে প্রশ্ন ছিল না, তেমন তো নয়। কিন্তু আমাদের মুক্তিযুদ্ধের নেতা, সাড়ে সাত কোটি মানুষ যার অঙ্গুলি হেলনে জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল; দেশের প্রথম নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি ও তার পরিবারের প্রত্যেক সদস্যকে এমন নির্দয়ভাবে হত্যা করার মতো কী এমন পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে! খুনিদের মূল ভাষ্য ছিল- দেশ ঠিকমতো চলছিল না। তেমন হলে তো একটি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় তার প্রতিকার পাওয়ার সংবিধান-নির্দিষ্ট পন্থা ছিল। সে জন্য ১৫ আগস্টের মতো ঘটনা ঘটানোর কি তাগিদ ছিল ওই ঘাতকদের? এই ভয়ংকর হত্যাকাণ্ডের পেছনে জাতীয় হোতাদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীদের যে যোগসাজশ ছিল- সে কথা কেউ অস্বীকার করবেন না। আমি আজ সে আলোচনায় যাব না। আমার প্রশ্ন অন্যখানে। মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় ধারণ করা এবং আওয়ামী লীগের সদস্যপদধারী এ দেশেরই লোক কী করে এবং কেন জাতির পিতাকে হত্যা করার মতো পন্থা বেছে নিল? শুধু তাই নয়; তার সহধর্মিণী, সদ্য বিবাহিত দুই পুত্র ও পুত্রবধূ, যাদের একজন ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা, শিশুপুত্র রাসেল ও আত্মীয় শিশু সুকান্ত বাবুসহ পরিবারের সবাইকে এমন হিংস্রতায় বধ করল! দেশকে তাদের মতে ‘অরাজকতা’ থেকে মুক্ত করতে এই পৈশাচিক কর্মকাণ্ড অবধারিত ছিল। গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে এ কথা অস্পষ্ট থাকে না- প্রকৃতপক্ষে প্রচণ্ড ক্ষমতালোভের সঙ্গে ভেতরে ভেতরে বঞ্চনার বোধ থেকেই এসব ‘বিপথগামী’ সৈনিক এবং ঘৃণ্য এক রাজনৈতিক ব্যক্তি ইতিহাসের এই ন্যক্কারজনক ঘটনাটি ঘটিয়েছে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল সার্বিক অর্থে একটি জনযুদ্ধ, যার চেতনায় ছিল সব মানুষের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির অঙ্গীকার; যার বীজ রোপিত হয়েছিল আমাদের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। তারপর বিভিন্ন পর্যায়ে পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক শোষণ, সাংস্কৃতিক স্বাধিকারের ওপর নিষ্পেশন, শিক্ষাব্যবস্থার সাম্প্রদায়িকীকরণ, মৌলবাদ ও ধর্মের দোহাই দিয়ে নারী স্বাধীনতা ও অধিকারকে শৃঙ্খলিত করার কৌশল, বৈষম্যমূলক শ্রেণিবিন্যাসের মতো অনাচার আর অবিচারের বিরুদ্ধে নানা আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ছয় দফা, এগারো দফা, ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের পথ ধরে আমরা একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে এসব বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা আছে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের গণরায় বানচাল করে দিতে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা যখন বাংলাদেশের মানুষের ওপর নির্বিচারে গণহত্যা শুরু করল, তখন এ দেশের মানুষ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ‘ঘরে ঘরে দুর্গ’ গড়ে তোলে এবং যার যা ক্ষমতা আছে তাই নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এ পর্যায়ে এসে বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষ সশস্ত্র যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙালি সদস্যরা মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে শুরু করে। এর আগে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন বা মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতির সঙ্গে কিছু ব্যতিক্রমী সেনাসদস্য ছাড়া এদের কারও সম্পৃক্ততার কোনো নজির আছে বলে জানা নেই। তবে সামরিকভাবে প্রশিক্ষিত হওয়াতে স্বাভাবিকভাবেই তারা মার্চ থেকে ডিসেম্বর- এই ৯ মাসের সশস্ত্র লড়াইয়ে নেতৃত্বের ভূমিকায় চলে আসে। অন্যদিকে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার রাজনৈতিক লড়াইটি বিশ্বব্যাপী চলতে থাকে তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে। সঙ্গে থাকেন অন্য রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ। বঙ্গবন্ধু শারীরিকভাবে যুদ্ধক্ষেত্রে অনুপস্থিত ছিলেন ঠিকই, কিন্তু প্রশ্নাতীতভাবে তিনিই ছিলেন এই বিরাট কর্মযজ্ঞের নৈতিক পরিচালক; সর্বাধিনায়ক। কিছু কুলাঙ্গার, যারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে দেশের মানুষের বিরুদ্ধে কাজ করেছে; হত্যা করেছে মুক্তিযোদ্ধাদের; সহযোগিতা করেছে হানাদার বাহিনীকে নারীদের ওপর নির্যাতন করতে; তারা ব্যতীত সবার জন্যই মুক্তিযুদ্ধের নেতা ছিলেন শেখ মুজিব। তাকে কেন এভাবে হত্যা করবে মুক্তিযোদ্ধা নামধারী এদেশেরই কিছু হঠকারী ব্যক্তি?
একটু ভেবে দেখলে এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া তেমন কঠিন বলে মনে হয় না। যথাযথ শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অধিকাংশ বাঙালি অফিসার ও সৈনিক নিশ্চয় বাংলাদেশের অন্যান্য সাধারণ মানুষের মতোই দেশপ্রেম এবং মুক্তির আকাঙ্ক্ষা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন; প্রাণ দিয়েছেন। তবে এদের মধ্যে যারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে শুধু ৯ মাসের সামরিক যুদ্ধ, যেটা আমাদের সমগ্র যুদ্ধের অবশ্যই অত্যন্ত গৌরবের এবং গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়; সেই সীমার মধ্যেই দেখেছে, তারা নিজেদেরই সে যুদ্ধের নায়ক বলে বিশ্বাস করেছে। রাজনীতিক ও সাধারণ মানুষের ভূমিকাকে এরা গুরুত্ব দিয়ে দেখার চেষ্টাই করেনি। ১৯৭১-এর ডিসেম্ব্বরে আমরা দেশ হানাদারমুক্ত করে স্বাধীনতা অর্জন করলাম। একে একে সবাই স্বজন হারানো ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তে ভেজা দেশের মাটিতে ফিরে এলাম। বঙ্গবন্ধু তখনও পাকিস্তানি শিবিরে বন্দি। সমরনায়করা দেশ পরিচালনার দায়িত্বটা নিজেদের হাতেই রেখেছেন। ছবির মতো চোখের সামনে ভাসে ইস্কাটন লেডিস ক্লাবে দপ্তর খুলে তারা নানা কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন। তখনও তাদের হাতে অস্ত্র এবং প্রায় সব ক্ষমতা। বছর শেষ হলো। জানুয়ারি মাস এলো। এলো ১০ জানুয়ারি। পাকিস্তান থেকে যুক্তরাজ্য আর ভারত হয়ে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিমান এসে নামল তেজগাঁও বিমানবন্দরে। লাখো-কোটি মানুষ ফিরে পেল তাদের প্রাণপ্রিয় নেতাকে। বিরামহীন অশ্রু, অন্তরের গভীরতম ভালোবাসা আর আনন্দে মানুষ বরণ করে নিল তাদের আপন মানুষটিকে, তাদের হৃদয়ের নেতাকে। বঙ্গবন্ধু অধিষ্ঠিত হলেন তার নির্দিষ্ট স্থানে, আপন মহিমায়।
প্রবল জনসমর্থনে দেশ ফিরে পেল তার রাজনৈতিক চরিত্র; প্রতিরক্ষা বাহিনী ফিরে গেল তাদের যথাস্থানে রাজনৈতিক নেতাদের অধীনে। অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী কিছু সেনা সদস্যের তাদের এই ফিরে যাওয়াটা মেনে নিতে কষ্ট হয়েছে। ক্ষোভ জমতে শুরু করেছে তাদের মনে। স্বাধীনতা-উত্তর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে শাসনব্যবস্থার দুর্বলতা, ব্যর্থতা, অদক্ষতার সুযোগ নিয়ে জাতিকে বিভ্রান্ত করার কাজটা সহজেই সমাধা করতে পেরেছে এরা বিরোধীপক্ষের সহযোগিতায়। এরা যদি সত্যিকার অর্থে তাদের দাবি অনুযায়ী দেশ রক্ষার জন্য এই ভয়ংকর হত্যাকাণ্ডটি ঘটাত, তবে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের সুবিধাভোগীরা ক্ষমতা দখল করেই সংবিধানের মূলনীতি থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাতিল করে দেবে কেন? রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় দেশকে সাম্প্রদায়িক রূপ দেবে কেন? মৌলবাদকে উস্কে দেবে কেন? যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসন করবে কেন? বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের প্রতি সমর্থন না থাকলে তার খুনিদের শুধু বিচার থেকে অব্যাহতি দেওয়া নয়; তাদের পুরস্কৃত করবে কেন? বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তানের আদলে গড়তে চাইবে কেন? কাপুরুষোচিতভাবে কারাগারে বন্দি রাষ্ট্রীয় হেফাজতে থাকা চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করবে কেন?
কারণ তাদের চেতনায় মুক্তিযুদ্ধ ছিল না। তাদের মননে বাংলাদেশ নয়; ছিল পাকিস্তানের ছায়া। তাদের হৃদয়ে ছিল না মানুষের অধিকার আর মর্যাদার বোধ। এদের আকাঙ্ক্ষা আবর্তিত ছিল শুধু একটা ভূখণ্ড দখলকে কেন্দ্র করে।
বাংলাদেশের ওপর দিয়ে অনেক ঝড়-জল বয়ে গেছে। পঁচাত্তরের পর কয়েকটি প্রজন্ম জন্মগ্রহণ করেছে। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে নানা বিভ্রান্তিকর তথ্য তাদের সরবরাহ করা হয়েছে। আজ বাংলাদেশের ৫০ বছরপূর্তিতে বাংলাদেশের স্বরূপটা চিনে নেওয়াই যেন হয় আমাদের ব্রত; বিশেষত যারা মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু আর বাংলাদেশ নিয়া নানা দ্বন্দ্বে ভোগেন। আজকে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে যেন তাকে পাই তার সত্যরূপে। ১৫ আগস্টে পরম মমতা আর শ্রদ্ধায় স্মরণ করি আমার মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদিত নেতা ও তার পরিবারের সেসব সদস্যকে, যারা মরণে হয়েছেন তার সহযাত্রী।
লেখক: মানবাধিকারকর্মী।