কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যখন শাহাদাতবরণ করেন তখন আমি ঢাকা কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। আদমজীনগর থেকে প্রতিদিন সকালে মিনিবাসে চেপে ঢাকার গুলিস্তানে নামি। সেখান থেকে বাসে বা রিকশায় ঢাকা কলেজ। লেখাপড়ার নামে সারা দিন কবিতার আড্ডা চলে কলেজ ক্যান্টিনে। কবিবন্ধু রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, জাফর ওয়াজেদ আড্ডার নিত্যসঙ্গী। বিকেলে আবার ফিরে যাই। আমার আব্বা আহমদ হোসেন চৌধুরী তখন আদমজী জুটমিলের প্রধান শ্রম ও কল্যাণ কর্মকর্তা। সে সুবাদে আমরা থাকতাম ১ নম্বর অফিসার্স কোয়ার্টারের বাসায়। বঙ্গবন্ধু হত্যার মর্মান্তিক দুঃসংবাদ সেদিন সকালে ঘুম থেকে জাগিয়ে আব্বাই আমাদের জানান। আকস্মিক এ সংবাদে হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিলাম।
আদমজীতে আমাদের পরিবার আওয়ামীপন্থী ও মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি হিসেবে পরিচিত ছিল। আব্বা ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা সরকারি কর্মকর্তা। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর তিনি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অধীনে চাকরিতে যোগদান করেননি। এ জন্য আদমজী জুটমিল কর্তৃপক্ষ আব্বাকে চাকরিচ্যুত করে। আমরা তখন থাকতাম পাড়ায় জে৩ কোয়ার্টারের ২৮ নম্বর বাসায়। ২৫শে মার্চের পর বিহারিরা আমাদের বাসা লুটপাট করে। পুরো ৯ মাস আমরা উদ্বাস্তু জীবন কাটিয়েছি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আব্বা চাকরি ফিরে পান ও মুক্তিযোদ্ধা সরকারি কর্মচারী হিসেবে তাঁকে দুই বছরের ভূতাপেক্ষ জ্যেষ্ঠতা দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড আমাদের পরিবারের জন্যও ছিল প্রচণ্ড আঘাতস্বরূপ।
১৫ই আগস্টের পর সব কিছু বদলে গেল। অনেক কষ্ট, রক্ত ও ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত ভালোবাসার পতাকা চোখের সামনে বন্দি হয়ে গেল স্বাধীনতাবিরোধী পরাজিত শত্রুর হাতে। বঙ্গবন্ধুর ঘাতক, ষড়যন্ত্রকারী ও একাত্তরের পরাজিত শক্তি মদদপুষ্ট সামরিক শাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট দেশ! আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের নেতাকর্মী, মুক্তিযোদ্ধা ও প্রগতিশীলদের ওপর নেমে এলো অত্যাচার, নির্যাতনের খড়্গ। কেউ কথা বলতে পারছে না, প্রতিবাদ করতে পারছে না। শুরু হয়েছে দেশের উল্টো যাত্রা। ৩ নভেম্বর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থান হলো। তার পরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে মিছিল বেরিয়েছিল। কিন্তু আবার আঘাত এলো ৭ নভেম্বর হঠকারী জাসদ নেতাদের সহায়তায় পাল্টা অভ্যুত্থান হলো প্রতিক্রিয়াশীলদের। ক্ষমতার রঙ্গমঞ্চে প্রকাশ্যে দেখা গেল মেজর জেনারেল জিয়াকে। সেদিন মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ, কর্নেল হায়দারসহ অনেক মুক্তিযোদ্ধা সামরিক অফিসারদের হত্যা করা হলো। এই যে একটা পরিস্থিতি যারা প্রত্যক্ষ করেনি সে সময় তারা ভাবতে পারবে না। কী কঠিন সময় দেশের বঙ্গবন্ধুর অনুসারীদের জন্য অগ্নিপরীক্ষার একসময়।
ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৭৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হলাম। ভেতরে জ্বলছে প্রতিবাদের আগুন; কিন্তু প্রকাশ্যে কিছু বলার সাহস হচ্ছে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ কর্মীরাও তখন সংগঠিত নয়। গোপনে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরাও গোপনীয়ভাবে তৎপর।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির পশ্চিম দিকে তখন দুটি ছাপরা খাবার দোকান। একটি শরীফ মিঞার ক্যান্টিন, অন্যটি গফুর মিঞার ক্যান্টিন। ষাটের কবি-লেখকরা আড্ডা দিতেন শরীফ মিঞার ক্যান্টিনে। আমরা যাঁরা সত্তরের দশকে লেখালেখি শুরু করছি তাঁরা গফুর মিঞার ক্যান্টিনে আড্ডা দেওয়া শুরু করলাম। সে সময়ে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী যাঁরা গোপনে কাজ করছিলেন তাঁদের সঙ্গেও যোগাযোগ শুরু হয়। আমি থাকতাম ফজলুল হক হলে, সেখানেও আমাদের গোপনীয় তৎপরতা শুরু হয়। এর মধ্যে আমরা যেতাম মাসিক সমকাল অফিসে। এই সময় মাসিক সমকাল পত্রিকা প্রকাশিত হতো ৭ ডিআইটি এভিনিউ থেকে। কবিরা সেখানেও আড্ডা দিতেন। বঙ্গবন্ধু হত্যা-পরবর্তী সময়ে এই সমকাল পত্রিকা সাহসী ভূমিকা পালন করেছিল।
তবে ১৯৭৭ সালের আগে প্রকাশ্যে ও স্বনামে প্রতিবাদ করার সাহস কবি-লেখকরা করতে পারেননি। ১৯৭৭ সালে প্রতিবাদী তৎপরতা প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে। সে সময় বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় সংসদ থেকে জয়ধ্বনি পত্রিকা বের হতো। ১৯৭৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে তারা বিশেষ সংখ্যা বের করে, যা ২১শে ফেব্রুয়ারির আগেই প্রকাশিত হয়। এতে আমার জাতীয়তাময় ‘জন্ম-মৃত্যু’ কবিতাটি প্রকাশিত হয়। কবিতাটি নিম্নরূপ—
রক্ত দেখে পালিয়ে গেলে
বক্ষপুরে ভয়
ভাবলে না কার রক্ত এটা
স্মৃতিগন্ধময়
দেখলে না কার জন্ম-মৃত্যু
জাতীয়তাময়।
বস্তুত এই কবিতাটি বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে স্বনামে প্রকাশিত প্রথম কবিতা। এ জন্য ১৩৮৫ বঙ্গাব্দে মাসিক সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রবন্ধে আমাকে পঁচাত্তর-উত্তর বাংলা কবিতার বলিষ্ঠ প্রত্যয়নিষ্ঠ সোচ্চার উচ্চারণের ভোরের পাখি আখ্যা দেওয়া হয়।
এর মধ্যে ১৯৭৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে একটা দুঃসাহসী প্রতিবাদের ঘটনা ঘটে গেল। নির্মলেন্দু গুণ বাংলা একাডেমির কবিতা পাঠের আসরে প্রকাশ্যে পাঠ করলেন, ‘আজ আমি কারো রক্ত চাইতে আসিনি, আমি শেখ মুজিবের কথা বলতে এসেছি’ কবিতাটি। প্রতিবাদ পেল নতুন মাত্রা। এ রকম পরিস্থিতিতে এলো ২৬শে মার্চ। সেদিন আদমজী জুটমিলের ১ নম্বর অফিসার্স কোয়ার্টারের মাঠে অফিসার্স সমিতি আয়োজন করে আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। আমাদের বাসার পাশেই ছিল একটা বড় পানির ট্যাংকি। তার সামনে একটা মাঠ, সেখানেই আয়োজন করা হয় এই অনুষ্ঠানের। তখন আদমজী জুটমিল এলাকা ইপিজেডে রূপান্তরিত হয়েছে। আমি ২০১৭ সালে সেখানে গিয়েছিলাম। বাসাবাড়ি কিংবা মাঠ এখন নেই। তবে পানির ট্যাংকিটা আছে।
সেদিন সন্ধ্যার সে অনুষ্ঠানের উপস্থাপক ছিলেন ২ নম্বর মিলের সহকারী ম্যানেজার কে এম নুরুল হুদা (বর্তমানে প্রধান নির্বাচন কমিশনার)। জনাব নুরুল হুদা একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সরকার মিল-কারখানা জাতীয়করণ করে। এসব প্রতিষ্ঠান যাতে সুন্দরভাবে পরিচালিত হয় সে জন্য তিনি ইন্ডাস্ট্রিয়াল ম্যানেজমেন্ট সার্ভিস নামে একটি ক্যাডার সার্ভিস গঠন করেছিলেন। হুদা সাহেব ১৯৭৩ সালে এই সার্ভিসে যোগ দেন। আমাকে তিনি কবিতা পড়তে আহবান জানালেন। এলাকায় কবি হিসেবে তখন আমি পরিচিত। প্রবল আবেগ ভর করেছিল আমার ভেতরে, আমি কবিতা পড়ার আগে দুঃসাহসী হয়ে উঠলাম। চিন্তা করলাম আজ যা-ই হোক বঙ্গবন্ধুর কথা বলব। সাতপাঁচ ভাবলাম না। আমার আব্বা চাকরিজীবী, তাঁর ক্ষতি হতে পারে, আমার বা আমাদের পরিবারের ক্ষতি হতে পারে, এমন ভাবনা আমাকে নিবৃত্ত করতে পারল না। কবিতা পড়তে উঠে ছোট্ট একটা বক্তৃতা দিয়ে ফেললাম। আমি বঙ্গবন্ধুর কথা বললাম। বললাম, তিনি আমাদের জাতির জনক, তিনি আমাদের স্বাধীনতা দিয়েছেন। আজ ২৬শে মার্চ তাঁকে স্মরণ না করে কোনো অনুষ্ঠান হতে পারে না। এই বলে আমি দুটি কবিতা পড়লাম। এর মধ্যে নির্মলেন্দু গুণের ‘আমি কারো রক্ত চাইতে আসিনি’ কবিতাও পড়লাম। শেষ করলাম ‘জয় বাংলা’ বলে।
আমি যখন বঙ্গবন্ধুর কথা বলছি তখন উপস্থিত দর্শক-শ্রোতাদের একাংশ ভীত হয়ে পড়লেন। অনেকে চেয়ার ছেড়ে দ্রুত অনুষ্ঠানস্থল ছেড়ে পালিয়ে গেলেন। অনেক চেয়ার খালি পড়ে রইল। আমি উত্তেজনায় কাঁপছিলাম। সাহস করে বঙ্গবন্ধুর কথা বলতে পেরেছি সে উত্তেজনায়। হুদা সাহেব মঞ্চে উঠে দর্শক-শ্রোতাদের বললেন, আমাদের ভাতিজা কবি কামাল চৌধুরী নিজ দায়িত্বে কবিতা পড়েছেন। আপনারা শান্ত হয়ে বসুন। তিনি যারা ভয় পেয়ে চলে গেছে তাদেরও ফিরে আসার আহবান জানালেন। এ পরিস্থিতিতে আমি আবার মঞ্চে উঠলাম। বঙ্গবন্ধুর কথা পুনরাবৃত্তি করে বললাম, আমি আবারও বলছি, বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ না করে ২৬শে মার্চের অনুষ্ঠান হতে পারে না। আমি এ-ও বললাম, আমি যা বলেছি নিজ দায়িত্বে বলেছি। বিবেকের তাড়না থেকে বলছি। আপনাদের ভয়ের কিছু নেই।
ঢাকার বাইরে সম্ভবত এটিই কোনো অনুষ্ঠানে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ। যাঁরা সেদিন আদমজী ছিলেন তাঁদের অনেকেই এখন বেঁচে নেই। জনাব হুদা এ নিয়ে লিখেছেন। যা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। সেদিনের কথা ভেবে আজও আমি শিহরিত হই। সেদিন এ সাহস দেখাতে পেরেছিলাম সে জন্য গৌরব বোধ করি।
লেখক: প্রধান সমন্বয়ক, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ির্ষকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি এবং প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্য সচিব, কবি।